ANUBHUMI

Sunday 4 August 2024

বাংরিপোসির দু'রাত্রি

বাংরিপোসি র দু'রাত্রি 

দুদিনের ছুটিতে টুক করে ঘুরে এলাম বাংরিপোসি।  অনেকে ভাবতে পারেন আমি কি করে ছুটি ম্যানেজ করি। না, বলে রাখি, আমি গত বছরে কলেজে একটাও CL  নেইনি। দিদির কল্যাণে আমরা DA তেমন না পেলেও ছুটি টুকটাক পেয়েই থাকি। তার সাথে অফ ডে আর রবিবার মিলিয়ে ছোটখাটো বেড়ানোর ছুটি ঠিক বেরিয়ে যায়। আর ঘর থেকে বেরোনোর ইচ্ছাটাই বড় কথা। 
          আমার দু একজন ভবঘুরে বন্ধু আছে, যারা 30 মিনিট এর আগাম খবরে  একটুও সময় নস্ট না করে বেরিয়ে পড়তে রাজি তাই সুবিধা আছেই। আর আমি একাই বহু জায়গায় ঘুরছি সেই ছাত্রাবস্থা থেকে। নাগপুর, দক্ষিণ ভারতের বেশ কিছু জায়গা আমি কবেই  B.A. পড়তে পড়তে একাই ঘুরে এসেছি রেলের চাকরি পরীক্ষার বাহানায়।  তার পর কত জায়গা আমি আমার মোটর সাইকেলে ঘুরেছি। হঠাৎ একদিন  মনটা পাহাড় পাহাড় করায় রাত আটটায় টায় মনে হল দার্জিলিং ঘুরে আসা যায়। 10 মিনিটে ব্যাগ গুছিয়ে  জেনারেল টিকিট কেটে দার্জিলিং মেলে। 
            কতবার চূড়ান্ত টিকিট এর ক্রাইসিস এর সময়ও ভেঙে ভেঙে, ট্রেন পাল্টে কত জায়গা ঘুরেছি।  আমার এই ভবঘুরেপনার একজন মাস্টার মশাই আছেন। তার থেকে আমার এই রোগ, যা আমার ভিতরে আগে থেকেই খানিকটা সুপ্তাবস্থায়  ছিল তা এখন মাস্টার মশাইয়ের শিক্ষার গুণে জেগে উঠেছে, আর মাথার পোকা টাকে অনবরত নাড়িয়ে চলেছে।  কেবল ই মনের ভিতর কে সে  থেকে থেকে যেন মনটাকে উতলা করে তুলছে।

            যাইহোক, হঠাৎ ই একদিন দুপুর বেলা একটু গান বাজনা সেরে বসে ইউটিউবে বেড়ানোর  ভিডিও দেখছি , মনে হল কোথাও ঘুরে আসা দরকার। অনেক ভেবে দেখলাম টেনে টুনে দুটো দিন ম্যানেজ করা যাবে। ঠিক করলাম যে বাংরিপোসি যাবো। বুদ্ধদেব গুহ-র 'বাংরিপোসির দু রাত্রি' পড়েছিলাম সেই কবে।  নানান জায়গা ভেবে শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম দুদিনের ছুটিতে বাংরিপোসিটাই বেড়িয়ে আসা যায়। খড়গপুর হয়ে যেতে হবে। রাজেশ-কস্তুরী রা থাকে মেদিনীপুরে, কস্তুরী কে বললাম যাবে? কস্তুরী তো দুপায়ে খাড়া, কিন্তু বাদ সাধলো আমার  বেরসিক বন্ধুটি, মানে কস্তুরীর জীবন সঙ্গী রাজেশ । তার নাকি এখন হবে না ।  তার কলেজের টিসিএস  সে, খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।  অগত্যা ওদেরকে বাদ দিয়েই বেরিয়ে পড়ব ভাবলাম।  ফেসবুকে উড়নচণ্ডী গ্রুপের কর্ণধার আমার খুব প্রিয়  শুভ স্যারকে নিয়ে যাওয়ার কথা মাথায় এল। কিন্তু এক ঘণ্টা আগে ওনাকে বলা অসভ্যতা হবে।  তাছাড়া উনি বলে রেখেছেন অন্তত একদিন আগে জানাতে। রঘুনাথ দাও বলে রেখেছেন কোথাও গেলে বলতে, ফ্রী থাকলে চলে যাবেন। কিন্তু রঘুনাথ দা-ও ব্যস্ত তালবাদ্য শিল্পী। এই ঘণ্টা খানিক আগে ওনাকে বলা মানে উনি যেতেও পারবেন না , আর যাওয়ার ইচ্ছাটাও হতে থাকবে, খারাপ লাগবে ওনার। 

       আর একটু আগে থেকে ভাবনা টা এলে আরও একটু প্ল্যানিং করে যাওয়া যেত, কিন্তু সেসব আমার ক্ষেত্রে খুব মুশকিল। গুগল ঘেঁটে প্রথমে ফোন করলাম হোটেল বাংরিপোসি তে। কিন্তু সেখান থেকে জানালেন যে রেনোভেশনের জন্য মাসখানিক বুকিং বন্ধ। তারপর  ফোন করলাম খৈরি রিসর্টে। ফোন বেজে গেল। তারপর ফোন করলাম সিমলিপাল রিসর্টে। কথা বলে জানালাম আজ যাচ্ছি, রাত 9 টা নাগাদ। 

           বাংরিপোসি তে থাকার খুব বেশি রিসোর্ট নেই, শুনেছি লুলুং বেশ ভালো রিসোর্ট, কিন্তু অত্যধিক ট্যারিফ হওয়ায় ওর কথা ভাবলাম না আর।
         দুপুর একটা নাগাদ বেরোনোর ইচ্ছাটা চাগার দিতেই স্নান খাওয়া সেরে গ্যারাজ থেকে গাড়ী বার করে লাগেজ তুলে ফেললাম। বেলা তখন আড়াইটা। ব্যাগ আমার একটা গোছানোই থাকে। তাই রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। 
বাংরিপোসি আমার বাড়ী নরেন্দ্রপুর থেকে প্রায় 230 কিমি, পাঁচ ঘণ্টা মত  লাগতে পারে গুগল ম্যাপ এর হিসেবে। আট টা সাড়ে আটটা নাগাদ পৌঁছে যাওয়া উচিত। 
          বাইরে এখন প্রচন্ড ভ্যাপসা গরম। বর্ষা কালের রোদ একদম পুড়িয়ে দিচ্ছে যেন। 

             কামালগাজি থেকে ই এম বাইপাস ধরে সায়েন্স সিটি র কাছ থেকে ' মা ' ফ্লাইওভার ধরলাম। বর্ষায় শরতের আকাশের মত পেঁজা তুলোর মেঘ আকাশে। মন টা ফুরফুরে হয়ে গেল। গাড়িতে সামনে পেছনে ড্যাশ ক্যাম থাকায় পুরো পথের ভিডিও নিতে সুবিধা হয়। মা ফ্লাইওভার পেরিয়ে ডান দিকে রবীন্দ্রসদন , ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল রেখে আর একটু এগিয়ে  দ্বিতীয় হুগলি সেতু তে যখন উঠলাম মাথার ওপর পেঁজা তুলোর মেঘ একটা মোহময় চিত্র তৈরি করে দিল। এই লেখার সাথে সে ছবি দিলাম দু একটি। 
সাঁতরাগাছি ফ্লাইওভার পেরিয়ে আরও এগিয়ে গিয়ে NH 6 ধরে খড়গপুর এর দিকে এগোতে থাকলাম। 
কোলাঘাট, দেউলটি, রূপনারায়ণ ব্রিজ পেরোলাম। দেউল্টি তে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বাসভবনে বার কয়েক এসেছি। এখানে প্রান্তিক আর নিরালা রিসর্টে ও আসা হয়েছে বেশ কয়েকবার। পাঁশকুড়া পেরিয়ে গেলাম। আরও কিছুটা গেলে খড়গপুর। তারপর আর একটু এগিয়ে ডান দিকের একটা রাস্তা ঢুকে যাচ্ছে মেদিনীপুরের দিকে। 
         সবে দিন 15 আগে মেদিনীপুরে কস্তুরী দের বাড়ী থেকে ঘুরে গেছি। ওর ছেলে মেয়ে দুটো র কথাও খুব মনে হতে থাকল।  ওরা নিয়মিত মা কে জ্বালায় ভিডিও কলে কথা বলার জন্য। কস্তুরী তো বেড়ানোর জন্য পাগল, তাই ওদের এত কাছ থেকে ওদের কে না নিয়ে যেতে মন খারাপ হতে থাকল। আর রাজেশের ওপর একটু রাগও হতে থাকলো। দুদিনের জন্য চলেই আসতে পারত।  আমি চললাম নাক বরাবর সোজা পথ ধরে।খড়গপুর থেকে আরও বেশ খানিকটা এগোলে রাস্তার দুপাশে পড়বে বিখ্যাত লোধাশুলি জঙ্গল। সেসব ও পেরিয়ে গেলাম। রিসোর্ট থেকে বলে রেখেছে বহরাগোড়া পৌঁছে ফোন করতে। 

         একটু ক্ষিধে ক্ষিধে পাচ্ছে। চা আর একটু স্ন্যাকস হলে ভালো হতো। আর কিছুটা এগোলে ঝাড়খন্ডে গিয়ে পড়ব।  বামহাতেই ভিগসন ধাবা পড়বে। যারা কলকাতা থেকে এই পথে গাড়ী নিয়ে বেড়াতে যান তাদের সবার কাছে ভিগসন ধাবা পরিচিত নাম। একটু আগে সিমলিপাল রিসোর্ট থেকে ফোন করেছিল, জানতে চাইছে আমি কখন পৌঁছব?  গুগল ম্যাপে ভিগসন ধাবা থেকে বাংরিপোসি 55 মিনিট দেখাচ্ছে। আমি বললাম পৌঁছতে একটু রাত্রি হবে, বললাম গিয়ে খাবার পাবো কিনা? ওরা জানালো সব পাওয়া যাবে। আমার সব চাই না , ভাত, ডাল, আলু ভাজা, আর ডিমের ঝোল হলেই আমার কাজ চলে যাবে। 

            ভিগসন ধাবা তে চিকেন পকোড়া আর কফি খেলাম। বেশ ভালো। এখানে 40 মিনিট মত লাগলো।  দু বোতল জল কিনে গাড়িতে উঠলাম, রাত সাড়ে আটটা পৌনে নটা  হবে। এখনও 55 মিনিট মত লাগবে। একটু এগিয়ে বহরাগোড়া থেকে বাম দিকে বোম্বে, নাগপুর রোড ধরে যেতে হবে ।   ওড়িশায় ঢুকে গেলে গাড়ির স্পিডে লাগাম লাগাতে হবে। এখানে 80 ওপর উঠলেই বাড়িতে ফিরে মোটা টাকার ফাইন এর মেসেজ আসতে পারে। আমার  গাড়িতে  80 র ওপর উঠলেই সতর্ক করে দেয়, আর আমি 80 র ওপর না চালানোর ই চেষ্টা করি সব সময়, সে আমার মোটর সাইকেলেও।
               এই পথে ওড়িশায় পৌঁছনোর আগে কিছু টা পথ ঝাড়খণ্ড এর ওপর দিয়ে যেতে হয়। ঝাড়খন্ডে পেট্রোল এর দাম কম বলে অনেকে পেট্রোল ভরে নেয়। আমিও নেব, কিন্তু ফেরার পথে। বেরোনোর সময় ট্যাংক ফুল করে এনেছিলাম। আর এক্সটার হাইওয়ে তে চমৎকার মাইলেজ দিচ্ছে , 25 এর মত।
                  ওড়িশায় ঢুকে বোম্বে, নাগপুর রোড ধরে কিছুটা এগিয়ে বাংরিপোসি ঢুকে গেলাম। আমি যে লেন দিয়ে যাচ্ছি তার উল্টো দিকের লেনে সিমলিপাল রিসোর্ট। কিন্তু হঠাৎ ম্যাপ কাজ না করায় ওই রাতে আমি 10 মিনিট মত বেশি চলে গেছি পাহাড়ের ওপরে। প্রচুর লরি চলছে। গাড়ী ঘোরানোর ঠিক জায়গা পাচ্ছি না। রাস্তার দুপাশে জনমানব নেই। অন্ধকারে মনে হল দুপাশে জঙ্গল। ঘোর অন্ধকার। কাউকে জিজ্ঞেস করার পাচ্ছি না। কিন্তু ম্যাপ কাজ করা বন্ধ করার আগে বুঝে নিয়েছি যে আমি একটু বেশি চলে এসেছি। নিশ্চয়ই উল্টো দিকের লেনে আমার রিসোর্ট। কিন্তু ডিভাইডার থাকায় অন্য দিকে যেতে পারছি না। যাইহোক, একটু এগিয়ে গাড়ী ঘুরিয়ে নিয়ে উল্টো দিকের লেনে গিয়ে ফোন করলাম রিসর্টে, কিন্তু আমি কোথায় আছি সেটাই তো বলতে পারছি না। রিসেপসনের ভদ্রলোক জানালেন যে রিসোর্ট টি রাস্তার ওপরে, প্রচুর আলো জ্বলছে, চিনতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ম্যাপে আমিও দেখে নিয়েছিলাম রাস্তার ওপরেই । যাইহোক, উল্টো দিকে কিছুটা এগোতেই প্রথমে চোখে পড়ল খৈরি রিসোর্ট, তারপর আর একটু এগোতেই শিমলিপাল রিসোর্ট চোখে পড়ল। রাস্তার ওপরেই ওদের রেস্ট্রন্ট, আর ভিতরে রিসোর্ট। এসি ডিলাক্স রুম বুক করাই ছিল। রুমে গিয়ে দেখলাম ঠিকঠাক পরিচ্ছন্ন রুম। তবে খুবই সাধারণ। স্নান সেরে খেয়ে নিলাম। এবার বিছানায় গা এলানোর পালা। 

             আগামী কাল যাবো বুড়িবালাম নদী দেখতে । তারপর যাব ব্রাহ্মণ কুন্ড।  তারপর সময় পেলে বাংকাবল ড্যাম আর সুলতপট  ড্যাম দেখব ,আর দুয়ারসিনি মন্দির দেখব। 
তবে তাড়াহুড়ো করে বেড়ানোর আনন্দ টা মাটি করতে রাজি নই মোটেই।
               রাতে বেশ ভালই ঘুমিয়েছি। প্রায় সাড়ে সাতটা অবধি ঘুমিয়েছি। তারপর চা দিয়ে গেছে। খেয়ে স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে লাগেজ গাড়িতে তুলে দিয়েছি। আমার প্ল্যান আজ বাংরিপোসি ঘুরে বিকেলের মধ্যে যদি সিমলিপাল ফরেস্ট এর দিকে চলে যাওয়া যায়। আর তা সম্ভব না হলে আজ রাত্রি বাংরিপোসিতে খৈরী রিসর্টে থাকব। মানুষের পোষ মানা মানুষের সান্নিধ্যে থাকা  একটি বাঘিনী খৈরি র নাম থেকে রিসর্টে র এই নাম।
                  ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম। পাশেই একটা জগন্নাথ মন্দির রয়েছে। কয়েকদিন আগেই রথযাত্রা গিয়েছে। রাস্তার ওপরে কাল রাতেই বড় রথ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। আজ জগন্নাথ মন্দির দেখে চললাম ঐতিহাসিক বুড়িবালাম নদী দেখতে। লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে জানলাম, স্থানীয়রা বুড়াবালাম বলে থাকে ।
                     রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে লোকের কাছে শুনে বুড়াবালাম নদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম । জল প্রায় নেই বললেই চলে । নদের বক্ষ তটের পাথর দৃশ্যমান। অল্প জল গ্রামের মেয়ে বউরা স্নান করছে। 
           কিছুক্ষণ বুড়াবালাম এর ব্রিজের ওপর  দাঁড়িয়ে দেখলাম নদের  দৃশ্য। এর পর  যাবো ব্রাহ্মণ কুন্ড। ওই পথেই এগোতে হবে আরও 23 কিমি মত পথ।  সময় লাগবে 55 মিনিট। 
                কিন্তু এই পথ পেরোতে আমার লেগে গেল কয়েক ঘণ্টা। এত অপূর্ব পথ খুব কম দেখা যায়।  দুপাশে ঘন জঙ্গল। মাঝখান দিয়ে পিচের রাস্তা। মাঝে মাঝে ছোট ছোট আদিবাসী গ্রাম। কী যে যে অসাধারণ সেই পথ কী বলি। একটু এগোতেই চারিদিকে পাহাড় মেঘের মত মাথা তুলেছে। আমি তো বিমুগ্ধ হয়ে দেখছি। ছবি তুলছি। ভিডিও করছি। এত অপূর্ব কোনও জায়গা, আমাদের এত কাছে এতদিন লুকিয়ে ছিল। কেন আসিনি? কেন এত কম ট্যুরিষ্ট জানে এই পথের হদিশ ভাবার চেষ্টা করছি। ভাগ্যিস বেশি লোকজন এই পথের হদিশ জানে না , নইলে এই অনাঘ্রাত আদিম অরণ্যানি এত সুন্দর অক্ষত থাকত কী না কে জানে ! 
আদিম অরণ্য কেন বলছি জানেন? কারণ একেকটা গাছের বয়স মনে হয় বেশ কয়েকশ বছর। এই বন জঙ্গল ঘেরা পথে, আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামের জংলী পথ দিয়ে যেতে যেতে আমার আনন্দে চোখে জল এসে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কতকালের অপেক্ষার পরে এই পথের সন্ধান পাওয়া গেছে। কোথাও জঙ্গলের মাঝে ছোট ছোট গ্রাম। গ্রামের চাষের জমি তে আদিবাসী মেয়ে পুরুষ একসাথে ধান চাষের কাজে ব্যস্ত। কী অপূর্ব ছবির মত সেসব দৃশ্য। 
              গ্রাম জঙ্গল পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি ব্রাহ্মণ কুন্ডের পথে। চারিদিকে ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড় মাথা তুলে সমস্ত দৃশ্যপটটা কেমন যেন স্বর্গীয় করে তুলেছে। এই তো চেয়েছি জীবনে। বর্ষার এই ঘন সবুজ জঙ্গল আর পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে স্বর্গের পথে পাড়ি দিতে। 

             মাঝে মাঝে গ্রামের লোকের কাছে জিজ্ঞেস করে এগোতে থাকছি ব্রাহ্মণ কুন্ডের দিকে।  অবশেষে পৌঁছেও গেলাম ঘনজঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ের মাঝখানে কুন্ডের মত ছোট পাথুরে জলাশয়, চারদিকের পাহাড় থেকে সেখানে ছোট ঝর্নার মত জল নামছে।  কুন্ডের  পবিত্র জলে প্রচুর বড় বড় মাছ । জায়গা টার চারপাশে জনমানব নেই। জঙ্গল-পাহাড়ের মাঝে পবিত্র এই স্থান। অনেক গুলো যজ্ঞ বেদির মত করা আছে দেখলাম। কোনও পার্বণে নিশ্চয়ই এখানে উৎসব হয় স্থানীয় মানুষের।
                  অনেকক্ষণ বসে রইলাম। গাড়ী পার্ক করেছি অনেক টা দূরে। জঙ্গলের পথ ধরে ফিরতে লাগলাম , দুটো কুকুর লেজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে এল। আমার কাছে কিছুই নেই ওদের কে দেওয়ার মত। গাড়িটাও অনেক দূরে। তাই ওদের কে , ওই কুন্ডের বিনা বেতনের রক্ষীদের কে কিছু না দিয়েই ফিরতে হল।
                  এবার আবার ফিরে যাব বাংরিপোসি র দিকে। সেখান থেকে গত রাতে যেখানে পথ ভুল করে পাহাড়ের ওপরের দিকে উঠে এসেছিলাম, সেই বাংরিপোসি ঘাটির দিক দিয়ে যাবো মা দুয়ার্সিনি মন্দির দেখতে।  তারপর বাঁকাবল ড্যাম আর সুলতপট ড্যাম দেখব।  
ব্রাহ্মণ কুন্ডের পথ দেখতে দেখতে বড় দেরি করে ফেলেছি। ফেরার পথে বুড়াবালাম এর আর একটা ব্রিজ এর ওপর অনেক ক্ষণ সময় কাটিয়েছি। নদের এই দিকটায় ভালই জল আছে। এখন বৃষ্টি হচ্ছে। গাড়িতে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ ব্রিজের ওপর থেকে বৃষ্টি দেখলাম , তারপর এগিয়ে চললাম। পাহাড়ী পথ বেয়ে বৃষ্টির রাস্তায় এগোতে থাকলাম। এই রাস্তায় প্রচুর ভারী ভারী লরি চলে। ওড়িশার ময়ুরভঞ্জ মাইনিং এরিয়া এটি। বেশ সাবধানে গাড়ী চালাতে হয় এই রাস্তায়। ওভারটেক করার উপায় নেই বললেই চলে, মুহুর্মুহু সামনের দিক থেকে ট্রাক চলে আসছে। অগত্যা বৃষ্টি মাথায় ধীরে ধীরে এগোতে থাকলাম। একটা ছোট বাজার মত এলাকায় দাঁড়িয়ে একটা ছোট  চা এর দোকানে চা খেলাম। সারাদিন কিছুই প্রায় খাওয়া হয়নি। সেই সকালে বেরোনোর আগে ডিম সেদ্ধ আর টোস্ট খেয়ে বেরিয়েছিলাম। তারপর থেকে তো আদিবাসী গ্রাম আর পাহাড় জঙ্গলের পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি, খাবো কোথায় ?গাড়িতে একটু বিস্কুট আর ড্রাই ফ্রুটস ছিল সেগুলো খেয়েছি মাঝে মাঝে।পর পর দুই কাপ চা খেয়ে বেশ ভালো লাগছে। এখন বিকেল গড়িয়ে এসেছে। দুটো ড্যাম দেখে সিমলিপাল ফরেস্টে যাওয়া কাজের কথা হবে না। রাতে জঙ্গলের মাঝে অসুবিধায় পড়ব। তার চেয়ে আজ রাতে বাংরিপোসিতেই থেকে যাবো।  এ যাত্রায় আর সিমলিপাল ফরেস্টে যাওয়া হবে না। 

              বাংকাবল ড্যাম বেশ ভালো লাগলো। সুলাতপট ড্যাম এর জন্য অন্য রাস্তা ধরতে হবে। রাস্তা টা নাকি বেশ খারাপ। তাই ভাবলাম সুলাতপট ড্যাম নেক্সটবার যখন আসবো তখন দেখে নেব। সূর্যাস্ত হতে দেরি নেই। পশ্চিমের আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে। ড্যাম এর বাঁধানো পাড়ে  বসে সেই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখলাম। তারপর ফেরার পথ ধরলাম। আসার পথে দুয়ারসিনী মন্দিরে দাঁড়ায়নি। ফেরার পথে দাঁড়াতে হবে। একটু এগোতেই সারি সারি ট্রাক এর জ্যামে ফেঁসে গেলাম। মোটেই এগোতে পারছি না। ধীরে ধীরে একটু একটু করে এগোতে এগোতে দুয়ার্সিনী মাতার মন্দিরে এসে পৌঁছে মন্দির দেখলাম। চোখে মুখে জল দিয়ে আবার গাড়ী স্টার্ট করলাম। 
এখন ট্যুরিষ্ট তেমন নেই, খৈরিতে রুম পেয়ে যাবো আশা করি। পেটে তো কয়েকশ ছুঁচো একসাথে ডন মারছে। খৈরিতে পৌঁছে আগে খেতে হবে। কিন্তু খৈরি তে ভাত হতে দেরি হবে। রুমও তেমন আহামরি লাগলো না ট্যারিফ অনুযায়ী।  সিমলীপাল রিসর্টে ফোন করতেই বলল স্যার আপনি চলে আসুন খাবার রেডি আছে, আপনার গতদিনের রুম টাও রেডি আছে। গরম গরম মাছ ভেজে দিচ্ছি, খেতে খেতে দেশী মুরগির ঝোল রেডি করে দেব। এর চেয়ে লোভনীয় প্রস্তাব আর কী হতে পারে। খৈরি থেকে বেরিয়ে পড়লাম গেলাম আবার সেই গতদিনের সিমলিপাল রিসর্টে।  গিয়ে স্নান সেরে বেরোতেই দরজায় টোকা, গরম মাছ ভাজা হাজির। বলল স্যার এটা খেয়ে বিশ্রাম করুন, রান্না রেডি হলে ডাকছি।  মাছ ভাজা আর চা খেয়ে সারাদিনের বেড়ানোর কথা ভাবতে লাগলাম। একটু পরেই ডাক পড়ল, ডাল, আলুভাজা, পটলের তরকারি, আর দেশী মুরগির ঝোল। সেসব খেয়ে শুয়ে পড়লাম। কাল সকালে ফিরতে হবে কলকাতায়। প্রচুর কাজ জমে আছে। সেসব ভেবেই কেমন মাথা ঘুরতে থাকল। কিন্তু আজ এসব ভেবে লাভ নেই। ফিরে দেখা যাবে কি করা যায়। 
                ব্যস দুরাত্রির  বাংরিপোসি ভ্রমণ শেষ।।

No comments:

Post a Comment