ANUBHUMI

Sunday 4 August 2024

আমার পুরুলিয়া ভ্রমণ

 আমার পুরুলিয়া ভ্রমণ পর্ব- ১


পুরুলিয়া আমায় মুগ্ধ করেছে। অল্প কয়েকমাসের ব্যবধানে দুবার পুরুলিয়া ঘুরে এলাম। প্রথমবার কলকাতা থেকে নিজে মোটরসাইকেল চালিয়ে, দ্বিতীয় বার গাড়ি চালিয়ে। প্রথম বার পুরুলিয়ার গড় সার্কিট শীতের  শুরুতে, দ্বিতীয়বার অযোধ্যা সার্কিট বসন্তে , মার্চের প্রথম সপ্তাহে। 

দুবার পুরুলিয়ার দুরকম রূপ আমায় মোহিত করেছে।  প্রথম বার পুরুলিয়ার ঘন সবুজ রূপে মুগ্ধ হয়েছি।  যেদিকে তাকাই রাস্তার দুপাশে সদ্য পাক ধরা হলুদে সবুজে মেশানো ধান ক্ষেত, আর দূরে সবুজ পাহাড় শ্রেণী। মাঝে মাঝে সুন্দর সব ছবির মত আদিবাসী গ্রাম, মাটির দেয়ালে সুন্দর করে রং করা। কত বার যে বাইক থামিয়ে ছবি তুলেছি তার হিসেব নেই। যেহেতু সঙ্গে কেউ নেই তাই কোথাও যাওয়ার কোনও তাড়া নেই। জয়চণ্ডী পাহাড়ের ইয়ুথ হোস্টেলে রুম বুকিং আছে ঠিকই , কিন্তু দেরিতে পৌঁছলেই বা কি! 

এর আগে যতবার পুরুলিয়া যাওয়ার প্ল্যানিং করেছি কোনো না কোনও কারণে তা শেষ মুহূর্তে এসে বাতিল হয়েছে। এবার তাই মনে জোর এনে বাইক নিয়ে ভোরে ভোরে বেরিয়ে পড়ি। দুর্গাপুর হাইওয়ে দিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আসানসোল মোড় এর কাছ থেকে বাম দিকে গুগল ম্যাপ এর দেখানো পথ ধরে এগোতে থাকি, আজকের গন্তব্য  জয়চণ্ডী পাহাড় । যখন এসে পৌঁছলাম তখন বেলা গড়িয়ে গেছে।  জয়চন্ডী পাহাড়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি যুব  আবাস আছে। আর আছে অল্প কয়েকটি বেসরকারি লজ।  যুব আবাসটি মন্দ নয়। একেবারে পাহাড়ের পাদদেশে। তবে মেইনটেন্যান্স এর বড় অভাব। এত বড় বিল্ডিং ক্যাম্পাস , কিন্তু রুমগুলিতে কিন্তু নিয়মিত ঝাঁট পড়ে না । তবে প্রতি ফ্লোরে পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে, রুমে আছে এসি, গিজার, টিভি। টিভি গুলো হয়ত চলে না , আমার যদিও সেসবে তেমন আগ্রহ নেই। ইয়ুথ হোস্টেলে খাওয়ার ব্যবস্থা নেই, খেতে যেতে হবে জয়চণ্ডী পাহাড়ের পাদদেশে। সেখানে ত্রিপল টাঙানো কয়েকটি গুমটি আছে। সকালে চা, মুড়ি, ছোলা সেদ্ধ, ঘুগনি, কচুরি আর দুপুরে ও রাতে ভাত, ডাল, সবজি, মাছের ঝোল, চিকেন  পাওয়া যায়। রাতের বেলায় গুমটি গুলোতে টিম টিম করে আলো জ্বলে , ইলেকট্রিসিটির ব্যবস্থা নেই গুমটি গুলোয়। রাত আটটা-সাড়ে আটটার পরে তেমন কেউ আসে না এদিকে। আর গুমটি ওলারা একটু আধটু নেশা টেশা করে তখন। 











জয়চন্ডী পাহাড়




জয়চন্ডী পাহাড়, পাহাড়ের পাদদেশে গুমটি




জয়চন্ডী পাহাড়



জয়চন্ডী পাহাড়


জয়চন্ডী পাহাড়



জয়চন্ডী পাহাড় যুব আবাস

জয়চন্ডী পাহাড় যুব আবাস

হলদে-সবুজ ধানক্ষেত

পাহাড়ের পাদদেশে গুমটি

পাহাড়ের পাদদেশে গুমটি, এখান থেকে খাবার যায় যুব আবাসে





জয়চন্ডী পাহাড় যুব আবাস 


তবে জায়গাটা ভারী সুন্দর, অনেক গুলো পাহাড় এর মাঝে ছোট্ট সুন্দর জায়গা। এই জয় চণ্ডী পাহাড়েই সত্যজিৎ রায় এর বিখ্যাত হীরক রাজার দেশের শুটিং হয়েছিল।  পাহাড়ের ওপর ওঠার সিঁড়ি আছে। পাকা , বাঁধানো। তবে উঠতে বেশ কষ্ট হয়। পাহাড়ের ওপরে মন্দির আছে, সেখানে পূর্ণার্থী দের পুজোর ব্যবস্থা আছে। আর পাহাড় চূড়া থেকে চার পাশের দৃশ্য ভারী মনোরম। পাশা পাশি একই উচ্চতায় তিন চারটি পাহাড়।

দুপুরে স্নান সেরে দীর্ঘ বাইক যাত্রার ক্লান্তি কাটিয়ে আবার বাইক নিয়ে চলে এলাম গুমটি গুলোয়  মধ্যাহ্ন ভোজন সারতে। খাবার অতি সাধারণ বললেও কম বলা হয়। কোনরকমে খাওয়ার পর্ব সেরে রাতের খাবারের অর্ডার দিয়ে  একটু রেস্ট নিয়ে পাহাড়ের ওপরে উঠতে থাকলাম। এই সময় তেমন পর্যটক নেই বললেই চলে।  চারিদিকে ঘন জঙ্গল। চেনা অচেনা নানা রকম বুনো গাছ ।  দেখলাম  শিয়া কুল এর ঝোপ,  বিষ্ণুপুরের জঙ্গলেও এই শিয়া কুলের ঝোপ দেখেছি অনেক। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুলে  ভরে থাকে গাছ। এই কুল শিয়াল খায় , তাই এর নাম নাকি শিয়া কুল। দেখলাম জঙ্গলে অনেক বেল গাছ। গাছে বেল ধরে আছে। তবে কাঁচা। অনেক টা সিঁড়ি ভেঙে উঠে পড়লাম  পাহাড় চূড়ায়। এখান থেকে সূর্য অস্ত যেতে দেখলাম। অনেক ক্ষণ পাহাড়ের ওপরে পাথরের ওপর বসে রইলাম।  মন্দিরে পুরোহিত পুজো দিচ্ছে। আর ওপরে কয়েকজন ঝাল মুড়ি, ছোলা সেদ্ধ, চানা ছোলা, কোল্ড ড্রিংকস, মিনারেল ওয়াটার, লেবুজল বিক্রি করছে।  একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। তার আগে নেমে এলাম। ইয়ুথ হোস্টেলে ফিরে এটা ওটা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঝিমুনি চলে এল বুঝতে পারিনি। প্রচণ্ড খিধেতে ঘুম ভেঙে গেল । ইয়ুথ হস্টেলে চা-ও পাওয়া যায় না। কাছাকাছি দোকান-পাটও নেই কিছু কিনে খাওয়ার। খুব ভুল করেছি সাথে কিছু শুকনো খাবার না রেখে। নিচে রিসেপসানে একটি ছেলে বসে আছে। তাকে গিয়ে চা এর কথা বলতেই জানালো একটু আগে ওই গুমটি গুলোর একটি ছেলে এসে চা দিয়ে গেছে ফ্লাক্সে। কিন্তু আমি  আগে থেকে বলে না রাখায় সে আর আমার কপালে জুটলো না। যাইহোক,  রাত সাড়ে আট টা ন'টা  নাগাদ ঘুমটি ওলা বাইকে করে খাবার দিয়ে গেল। রুটি, ডিমের কারি। আমি ছাড়া ও আরো দু একটি ফ্যামিলি আছে দেখলাম ইউথ হোস্টেলে। তারাও খেল।

পরের দিন আমার গন্তব্য গড় পঞ্চকোট, পঞ্চেট ড্যাম, বড়ন্তি হয়ে পশ্চিম বঙ্গ ঝাড়খন্ডের বর্ডারে অবস্থিত মাইথন ।

সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ে পঞ্চকোট যাওয়ার পথে রাস্তায় একটা দোকানের পাশে বাইক দাঁড় করিয়ে গরম গরম কচুরী,ছোলা আলুর তরকারি আর গরম ভাজা অত্যন্ত সুস্বাদু জিলিপি দিয়ে প্রাতরাশ পর্ব সেরে নিলাম। আহা, এই জিলিপির স্বাদ কলকাতার জিলিপির থেকে একেবারে আলাদা। জয়চন্ডী পাহাড় যুব আবাস থেকে গড় পঞ্চকোট যাওয়ার দুটো রাস্তা দেখায় গুগল ম্যাপ। প্রথমটি আসানসোল-পুরুলিয়া রোড ২০ কিলোমিটার। সময় লাগে কম বেশি ৪০ মিনিট। আসানসোল-পুরুলিয়া রোড ধরে ১৬ কিমি গিয়ে বামদিকে গোবাগ আই সি ডি এস- গড়পঞ্চকোট ধারা রোড ধরে ৩ কিমি মত গেলেই গড় পঞ্চকোট পৌঁছে যাওয়া যায়। দ্বিতীয়টি খাজুরা-সেনেরা রোড ধরে ১৪ কিলোমিটার মত গিয়ে আসানসোল –পুরুলিয়া রোডে পৌঁছে আরো ৩ কিলোমিটার মত গিয়ে গোবাগ আই সি ডি এস- গড়পঞ্চকোট ধারা রোড ধরে ৩ কিমি মত গেলেই গড় পঞ্চকোট । আমি প্রথম পথটি ধরলাম।   এই শেষের ৩ কিমি পথটি অনবদ্য। দুপাশে পলাশ, মহুয়া, ছোট ছোট শাল, ইউক্যালিপটাস , সোনা ঝুরি , আম, জাম, খেজুর ইত্যাদি গাছের জঙ্গল। মাঝখান দিয়ে ছোট, কালো পিচের রাস্তা। একটু এগোতেই দুপাশে জঙ্গল ঘন হতে থাকে। তবে মাঝে মাঝে ছোট ছোট আদিবাসী গ্রাম ।  মালভূমি এলাকা। মাঝে মাঝে জঙ্গলের মাঝে মাঝে একফালি করে ধানের খেতে সোনালি সবুজ কাঁচা পাকা ধানের ক্ষেত। আর কাছে দূরে সবুজ জঙ্গলে ঠাসা পাহাড় শ্রেনি। দেখতে পারেন আদিবাসি মহিলা-পুরুষের মাথায় করে জঙ্গলের শুকনো ডালপালা নিয়ে যেতে, কিম্বা দেখবেন গরু-মহিষের পাল নিয়ে রাখাল বালককে। বাইকে এই পথ চলতে চলতে বারবার ই মুগ্ধ হচ্ছি।  পথে আসতে আসতে দেখলাম বেশ কিছু জায়গায় খেজুর গুড় তৈরি শুরু হয়েছে। যদিও এখনও জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েনি।          

                                             চলবে ....



জামাইয়ের মিষ্টান্ন ভাণ্ডার

জামাইয়ের মিষ্টান্ন ভাণ্ডার





প্রাতঃরাশ

খেজুর গুড় তৈরি হবে


                                            চলবে ....

No comments:

Post a Comment