একটা স্বপ্নের লং- জার্নি
প্রথমবার পুরুলিয়া যাওয়ার গল্পটা তো শেষ হল না। তার আগেই দ্বিতীয়বার পুরুলিয়া যাওয়ার গল্পটা শুরু করলাম। দ্বিতীয় বারের যাত্রা টা যদিও শুধু পুরুলিয়া ছিল না সাথে আরও অনেক জায়গা ঘোরা হয়ে গেল একযাত্রায়। পাত্রসায়ের এ একটি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সমারোহে যোগ দেওয়াই ছিল এই যাত্রার প্রাথমিক উদ্দেশ্য। সাথে বসন্তে বাঁকুড়া- পুরুলিয়ায় কয়েকটা দিন কাটানোর আগ্রহও ছিল।
বাঁকুড়া পুরুলিয়ায় বসন্ত একেবারেই আলাদা ধরনের হয়। আর এই যাত্রায় বিশেষ আগ্রহের আরও একটা কারণ ছিল নুতন বাহন Hyundai Exter চালিয়ে পাহাড় যাত্রার হাতে খড়ি। সেজন্য আগ্রহের অন্ত ছিল না।কিন্তু সত্যি বলতে কি মনে ভয়ও ছিল। সবে টানা 25 দিনের ড্রাইভিং স্কুলের ট্রেনিং শেষ করে একজন ভালো ড্রাইভিং স্কুলের এর এক্স ট্রেনার কে পাশে বসিয়ে 10 দিন মত নিজের গাড়িতে প্র্যাকটিস সেরে নিয়েছি। সেই ভদ্রলোক এর কাছেই আমি এমন অনেক কিছু শিখলাম যা ট্রেনিং স্কুলে শিখিনি। দিন সাতেক পরে তিনি আমায় certificate দিয়ে দিলেন যে এবার আমি একদম একা চালানোর জন্য রেডি। বাকি যা শেখার সেটা কারুর কাছে শেখার নয়, পথেই চালাতে চালাতে শিখতে হবে। আমি দু দশকের মত মোটর সাইকেল চালাচ্ছি। তাই রাস্তাঘাট আর রাস্তাঘাটের নিয়ম কানুন এর সাথে আমি ভালই পরিচিত। গতির ভীতিও সেই কারণেই আমার কম। যাইহোক তাও যেহেতু আমার সাথে দুজন সিনিয়র মিউজিসিয়ান শ্রী প্রদীপ ভট্টাচার্য ও শ্রী রঘুনাথ নন্দী যাবেন, তাই ঠিক হল একজন ড্রাইভার নেব পাত্রসায়ের অব্ধি। ওখানে পৌঁছে ড্রাইভার কে ছেড়ে দেব। সে ট্রেনে কলকাতা ফিরে যাবে, আর পর দিন সকালে দুই মিউজিসিয়ানও ট্রেনে কলকাতা ফিরবেন , আর সেখান থেকে আমার যাত্রা শুরু হবে প্রথমে বিষ্ণুপুর, তারপর সেখান থেকে বাঁকুড়া হয়ে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় সার্কিট। তারপর অবস্থা বুঝে অন্যান্য জায়গা।
সন্ধ্যায় প্রোগ্রাম। আমরা কলকাতা থেকে রওনা দিলাম সকাল সাড়ে আট টা নাগাদ। ড্রাইভার কে পাশে বসিয়ে নিজেই ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলাম। ই এম বাইপাস ধরে মা ফ্লাইওভার ধরে দ্বিতীয় হুগলি সেতু দিয়ে NH 16 ধরে সোজা যাত্রাপথ। বেশ খানিক টা পথ নিজে চালালাম, বাকিটা ড্রাইভার । দুপুরের মধ্যে পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্যে। দুপুরের খাওয়া দাওয়া সারা হল বাঁকুড়ার বিখ্যাত আলু পোস্ত, সাথে ডাল, বেগুন ভাজা, মাছের ঝোল, চাটনি, পাঁপড়, মিস্টি দিয়ে। বিকেলে রেস্ট নিয়ে সন্ধ্যায় প্রোগ্রামে আমরা গান বাজনা করলাম। রাতে প্রোগ্রাম অরগানাইজারের বাড়ীতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। পর দিন ভোরেই উঠে পড়তে হবে , প্রদীপ বাবু আর রঘুনাথ দা কে পাত্রসায়ের স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আমি যাত্রা শুরু করব বিষ্ণুপুরের উদ্দেশ্যে।
রাত থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ভোরে উঠে দেখি বৃষ্টি পড়ে ই চলেছে। ভোরে উঠে স্নান সেরে, রেডি হয়ে চা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। স্টেশন 15 মিনিট মত পথ। তখনও ভোরের আলো পুরোপুরি ফোটেনি। রাস্তা ফাঁকা। বৃষ্টি পড়ছে ভালই। দুজনকে স্টেশনে এগিয়ে দিয়ে আমি বিদায় নিলাম। দুজন আমায় অনেক অভয় যুগিয়ে গেলেন, আর সেখান থেকে বেলিয়াতোড় হয়ে বিষ্ণুপুরের রাস্তা বুঝিয়ে দিলেন। ওরা চলে যেতেই একটু ভয়ই পেলাম। গাড়ী নিয়ে এতটা পথ একা যেতে হবে...
আমি একটা পেট্রোল পাম্প থেকে প্রথমে তেল ভরালাম। গাড়িতে তেল ভরানোর অভিজ্ঞতাও আমার এই প্রথম বার। 🤭 ঠিক ছিল বেলিয়াতোড় হয়ে বিষ্ণুপুর যাব, সেখান থেকে আমার এক বন্ধু উঠবে গাড়িতে আমার সঙ্গী হতে।
বিষ্ণুপুরের সাথে আমার বহুদিনের সম্পর্ক। এখানে রামানন্দ কলেজে আমি আট বছর পড়িয়েছি। এখান থেকেই আমার আসল কর্মজীবন আর সঙ্গীত জীবনের শুরু। এখানে অনেকেই আছেন যাঁরা আমার চিরকালের আপন হয়ে রয়ে গেছেন।
পেট্রোল পাম্পের ছেলেটি বিষ্ণুপুর যাওয়ার সম্পূর্ণ একটা নুতন পথ বলে দিল, রাস্তা নাকি পুরোটাই চমৎকার সুন্দর, আর ফাঁকা। নুতন ড্রাইভার এর জন্য এর চেয়ে লোভনীয় প্রস্তাব আর কি হতে পারে!
সমস্যা হল বৃষ্টি থামার নাম গন্ধ নেই। রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে তাই বৃষ্টি থামার প্রতীক্ষা করে সকাল হতেই যাত্রা শুরু করলাম বিষ্ণুপুরের উদ্দেশ্যে। বৃষ্টিস্নাত সকাল বেলায় গ্রাম, বিল , মাঠ এর মাঝখান দিয়ে নুতন কালো পিচের রাস্তা । আহা জীবনে এই তো চেয়েছি। অচেনা, অজানা গ্রাম, জঙ্গল, শহর পেরিয়ে অনির্দিষ্ট পথে পাড়ি জমানো ।
বিষ্ণুপুর বহু প্রাচীন শহর। অপ্রশস্ত রাস্তা, আর অসংখ্য গলিঘুঁজি। শহরের মধ্যে ঢুকতেই এক অটো রিক্সা হালকা করে ছুয়ে দিয়ে গাড়িতে তার দাগ রেখে গেল। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বিষ্ণুপুর স্টেশন এর কাছ থেকে বন্ধুকে তুলে নিয়ে বাঁকুড়ার পথ ধরলাম । রাস্তায় কোনও ধাবাতে লাঞ্চ সারতে হবে।
Hyundai Exter কী দারুন গাড়ি বানিয়েছে। আহা, একটুও কষ্ট ফিল করছি না, বরং মন ফুরফুরে হয়ে আছে। পাশে বন্ধু থাকায় সেটা অনেক গুণ বেড়েও গেছে। আর এতটা পথ একা চালিয়ে ভয় টাও আর নেই। পাশে বন্ধু থাকায় বেশ ভালও লাগছে। গল্প করতে করতে
আমরা এগিয়ে চলেছি। দ্বারকেশ্বর নদীর উপরের ব্রিজ পেরিয়ে আমরা এগোতে থাকলাম বাঁকুড়া র দিকে। বাঁকুড়া ওন্দা কলেজের পাশে একটা চা জলখাবারের দোকান থেকে অল্প এটা ওটা খেয়ে নিলাম । তারপর আবার যাত্রা শুরু। অযোধ্যা পাহাড় পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে যাওয়ার কথা। কারণ আমরা ধীরে ধীরে রাস্তার মজা নিতে নিতে , গল্প করতে করতে , থামতে থামতে চলেছি। কোনও তাড়াহুড়ো নেই।
বাঁকুড়া র ধলডাঙ্গা মোড় থেকে বামদিকের রাস্তা ধরলাম। রাস্তা মাখনের মত মসৃণ। গ্রাম, ছোট ছোট জনপদ, শহর পেরিয়ে চলতে লাগলাম।
আরও অনেক টা পথ এভাবে চলতে চলতে রাস্তার দুদিকের দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকলো। রাস্তার দুপাশে দু একটি করে পলাশ গাছ দেখতে পাওয়া গেল। তাতে সদ্য ফুল এসেছে। ক্রমশ দুধারে অসংখ্য পলাশ গাছ দেখতে পেলাম।
একটু এগোতে একটা ছোট্ট জনপদ । রাস্তার মোড়ে দোকান। দেখলাম কাঁচা ছোলার ঝাড় (ছোলা গাছ )ছোলা সহ বিক্রি হচ্ছে। স্কুলের ছেলে মেয়েরা ছোট ছোট দল বেঁধে ফিরছে। সবার হাতে ছোলার গাছ, ছিঁড়ে ছিঁড়ে কাঁচা ছোলা চিবোচ্ছে। আমার বন্ধুটি আদতে কলকাতার মানুষ। সে এ দৃশ্য প্রথম দেখছে। তাকে বললাম কিনতে। 5/7 টাকায় অনেকটা ছোলা সহ গাছ পাওয়া গেল। দু-একটা খেয়ে দেখলাম বেশ মিষ্টি। একটা দোকানে দেখলাম গরম গরম জিলাপি ভাজা হচ্ছে। আহা। সে কি আর মিস করা উচিত? এক ঠোঙা জিলাপি কেনা হল।তারপর কাঁচা ছোলা, জিলাপি, আর জল খেয়ে আবার শুরু হল আমাদের যাত্রা।
বিকেল হয়ে গ্যাছে। একটু এগোতে দেখলাম দূরে চতুর্দিকে পাহাড় মাথা তুলেছে। চারিদিকে পাহাড়। চোখ জুড়িয়ে গেল। এই প্রথম পাহাড়ে গাড়ি চালাব। আমার বন্ধুটি সেটা ভেবেই একটু আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। আমি অভয় তো দিলাম, কিন্তু ভয়ও হচ্ছিল। অযোধ্যা পাহাড়ে অনেক গুলো শার্প টার্ন আছে, হেয়ারপিন বাঁক আছে, আর হঠাৎ করে বেশ খাড়াই । পুরো দার্জিলিং এর রাস্তার ফিল খানিকটা পাওয়া যায়। বন্ধুটি রীতি মত শক্ত হয়ে বসে আছে। আমি সাহস অর্জন করলাম। এখানে পিছিয়ে আসার কোনো উপায় নেই। গাড়ি স্মুথলি ওপরে উঠতে থাকলো। আকাশে প্রচুর মেঘ করেছে । এখুনি ঝড় বৃষ্টি নামবে। হেয়ারপিন বাঁক ঘুরে পাহাড়ে উঠছি অবলীলায়। ভিতরে ভিতরে তৃপ্ত হচ্ছি। এত সহজে বাইকও উঠত না। Hyundai Exter SX MT যে কনফিডেন্স এর সাথে পাহাড়ে চলতে সাহায্য করল তার কোনও তুলনা হয় না ।
নিচে পাহাড়ের ঢালে দু একটি ছোট খাটো হোটেল হোমস্টে দেখেছিলাম। কিন্তু পাহাড়ের ওপরে একটাও হোটেল চোখে পড়ছে না। পাহাড়ে রাস্তার দুধারে ঘন জঙ্গল। এই দৃশ্য ভোলার নয়। এখুনি বৃষ্টি নামবে। একটু এগোতেই হিলটপ এ হোটেল এর বিজ্ঞাপন দেখতে পেলাম। দু একটি দেখলাম। মন্দ নয়। কিন্তু আরও দুয়েকটা দেখা দরকার। এই সময় মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। তার মধ্যেই একটু দূরে একটা ভালো হোটেল চোখে পড়ল। সেখানে ওই প্রবল বৃষ্টির মধ্যে গাড়ী ঢুকিয়ে দিলাম। বন্ধু নেমে রিসেপশনে কথা বলতে গেল। রুম আছে। পুরুলিয়ার অযোধ্যা হিল টপে যে কয়টি বড় মাপের হোটেল আছে এটি তার মধ্যে অন্যতম সুন্দর।
হোটেল Hotel saffron Valley and Resort, অযোধ্যা হিলটপে যতগুলো ভালো হোটেল আছে এটি তার মধ্যে অন্যতম। এর অবস্থান, পরিচ্ছন্ন স্পেসিয়াস রুম, সুন্দর সুইমিং পুল, পুল লাগোয়া লন, ছোট্ট পলাশের বাগান সুন্দর আলো আর বসার ব্যবস্থা এককথায় অসাধারণ। স্টাফদের ব্যবহার আর খাবারের কোয়ালিটি ও স্বাদ অনবদ্য। রুমের জানালা দিয়ে সবুজ পাহাড় আর জঙ্গল দেখা যায়। মুগ্ধ হতে হয়। সারাদিনের জার্নিতে আমরা ক্লান্ত ছিলাম। তাই পরিচ্ছন্ন ধবধবে বিছানায় গা এলাতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে জানলা খুলতেই ঝকঝকে আকাশ, আর পাহাড় , জঙ্গলের রূপে মোহিত হয়ে গেলাম । পুরুলিয়া এত সুন্দর জানতাম-ই না। জানলার পাশে চা এর কাপ নিয়ে বসে গল্প করতে করতে দুপাশের দৃশ্য দেখতে থাকলাম। রুমের সাথে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট সারতে নিচে ডাইনিং হলে যেতে হবে । বেশ হেভি ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা হোটেলের চারপাশটা একটু হেঁটে ঘুরে এলাম। বেশ ভালোলাগলো। আজই আমরা হোটেল ছেড়ে দিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ের দর্শনীয় স্থান গুলো দেখে নেব।
গতকাল যেভাবে পাহাড়ের পাকদণ্ডী পেরিয়ে অযোধ্যা হিলটপে উঠে গেছি, তাতে আমার বন্ধুটি বেশ পুলকিত, সেই সাথে যেন একটা বিস্ময়ের ঘোর ও রয়েছে। আজ হোটেল থেকে বেরিয়েই তার সাবধান বানী, পাহাড়ে ওঠা যত সোজা , নামা কিন্তু ততটাই কঠিন। কিন্তু আমি কনফিডেন্ট, এক্সটার এর যা পারফরমেন্স দেখলাম আমি নিশ্চিত কোনও অসুবিধাই হওয়ার কথা নয়।
হোটেল ছেড়ে দেওয়ার আগে চারপাশ টা একটু হেঁটে ঘুরে নিলাম। খুব সুন্দর। গতকাল সন্ধ্যায় যে পথে হিলটপে উঠেছিলাম, তার উল্টোদিকের রাস্তা ধরব আমরা। পথে দেখে নেব ময়ূর পাহাড়, মার্বেল লেক, আপার ড্যাম , লোয়ার ড্যাম, থুর্গা ড্যাম, থুর্গা জলপ্রপাত ইত্যাদি। পাহাড় আর ঘন জঙ্গলে ঘেরা এই সব স্থান গুলো এককথায় অসাধারণ। পলাশ গাছ পলাশ ফুলে ভরে উঠছে। আর দিন পনের পরে পাহাড় আগুন রঙে সেজে উঠবে পলাশে। তবে আমরাও ভালই পলাশ পেয়েছি। মুরগুমা ড্যাম, ক্ষয়রাবেড়া ড্যাম ,আর মুখোশ গ্রামে আর এই যাত্রায় যাওয়া হল না। আমরা ভাবলাম পুরুলিয়ায় আর একটা দিন না থেকে জামশেদপুর চলে গিয়ে ওখানে রাত্রি যাপন করব।
জামেশদপুর যাওয়ার কোনও পরিকল্পনা ই ছিল না আমাদের। কিন্তু হঠাৎ-ই ঠিক করে নিলাম, পুরুলিয়ায় বরং পরে যখন আসবো এই রুটের বাকি দর্শনীয় স্থান গুলো তখন ঘুরে নেওয়া যাবে। তাছাড়া আমি যেহেতু প্রতি মাসেই কোথাও না কোথাও ঘুরতেই থাকি তাই পুরুলিয়ায় পরে খুব তাড়াতাড়ি নিশ্চয়ই আবার আসা হবে।
অযোধ্যা পাহাড় থেকে জামশেদপুর এর দুরত্ব দেখাচ্ছে 82.6 কিলোমিটার এর মত। সময় লাগার কথা গুগল ম্যাপ অনুযায়ী 2 ঘন্টা 23 মিনিট। এদিকের রাস্তাঘাট বিশেষ চিনি না, গুগল ম্যাপ ভরসা। স্থানীয় মানুষ জন এর সাহায্য নেওয়া যায় বটে, কিন্তু গাড়ি থামিয়ে লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করা টা একটা ঝক্কি । ম্যাপ দেখলে কাজটা অনেক সহজ হয়।
প্রথম দিকে রাস্তা এতটাই অসাধারণ যে বলে বোঝানো যাবে না। রাস্তার দুপাশে ঘন সবুজ জঙ্গল, গ্রাম, শহর , জনপদ আর মসৃণ কালো পিচের রাস্তা।
ঠিক কোন রাস্তা দিয়ে জামশেদ পুর গেলাম সেটা আর মনে নেই, কিন্তু ন্যাশনাল হাইওয়েতে উঠতেই দেখি সারি সারি ট্রাক, বাস, ছোট গাড়ি । লম্বা জ্যামে ফেঁসে গেলাম। রাস্তা মেরামতির কাজ হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে, তাই এত ডাইভারশন, এত জ্যাম। এই রাস্তায় এত লরি , ট্রাকের মধ্যে কী করে গাড়ী চালাবো ভেবেই মাথা ঘুরতে লাগলো আমার। অথচ এখান থেকে পিছনে যাওয়ার পথও বন্ধ। কিছু করার নেই। একটু একটু করে এর মধ্যেই এগোতে হবে। রাস্তা জুড়ে ধুলো, কাদা , অফ রোডিং টাও প্র্যাকটিস হয়ে গেল এই যাত্রায়। দীর্ঘ পথ এভাবে থামতে থামতে চলতে চলতে চারিদিকে অন্ধকার নেমে গিয়েছে ততক্ষণে। এখনও অনেক পথ বাকি। আরও কিছুক্ষণ এভাবে চলতে চলতে ভালো রাস্তায় পৌঁছে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে মনে নিজের ড্রাইভিং এর জন্য নিজেরই পিঠ চাপড়াচ্ছি। বন্ধু টিও এতক্ষণে অনেকটাই নিশ্চিন্ত যে আর কোনও ভয় নেই নূতন ড্রাইভার কে নিয়ে। তখনও অবধি আমি ড্রাইভিং স্কুলের অখাদ্য গাড়ী আর আমার এক্সট্রার ছাড়া অন্য গাড়ী চালায়নি। তাই বলতে পারব না অন্য গাড়ী চালানোর অনুভূতি। কিন্তু Hyundai Exter SX MT আমায় যা অনুভূতি দিল আমি তাতে সত্যিই মুগ্ধ হয়ে গেছি।
ঠিক হল রাতে আর জামশেদপুর শহরের মধ্যে না ঢুকে হাইওয়ে র কাছে কোনও ভালো হোটেল দেখে রাত্রি কাটাব। দু একটি হোটেল দেখা হল, যেমন হিল ভিউ , কিন্তু ট্যারিফ অনুযায়ী ভালো লাগল না । তারপর আমরা উঠলাম হোটেল আসানবনী 10th Mile Stone Hotel এ। বেশ বড়সড় প্রপার্টি। রাতে ডিনার সেরে আড্ডা দিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
সকালে উঠে হোটেলের বিরাট লন, আর ফুলের বাগান ঘুরে দেখলাম। হোটেল থেকে দলমা পাহাড় দেখা যায়।কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা এবার বেরিয়ে পড়লাম ডিমনা লেকের উদ্দেশ্যে। ডিমনা লেক যাওয়ার রাস্তাটা ভারী সুন্দর। পথে একটা বহু প্রাচীন কালী মন্দির দেখে আমার বন্ধুটি যেতে চাইল। মন্দিরের পুরোহিত মশাইয়ের সাথে কিছুক্ষণ গল্প হল। তিনি মন্দির লাগোয়া একটা ছোট ঘরে থাকেন। এখানে নাকি রাতে হাতিও এসেছে। সেসব গল্প বললেন। আমাদেরকে প্রসাদ খেতে দিলেন। জলখেলাম। তারপর আবার রওনা দিলাম। পুরো যাত্রায় আমরা সবচেয়ে বেশি মজা নিয়েছি পথের । রাস্তার দুপাশে কত কিছুই যে দেখার থাকে, সেটা যাঁরা দেখতে জানেন তাঁরা জানেন।
ডিমনা লেক দারুন লাগলো। লেক এর ওপারে দলমা পাহাড়ের বিস্তৃত রেঞ্জ। আমরা অনেকক্ষণ লেকের এর কাছে সময় কাটিয়ে, ছবি তুলে রওনা দিলাম ঘাটশিলা র উদ্দেশ্যে। জামশেদপুরে পরে আবার ও আসবো, সময় নিয়ে পুরোটা ঘুরব এই সংকল্প নিয়ে আমরা ঘাটশিলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
ডিমনা লেকটি শহরের জলের সমস্যা মেটাতে টাটা রা নাকি কৃত্রিম ভাবে তৈরি করেছিলেন। খুব সুন্দর। ডিমনা লেক এর ওপারে দলমা পাহাড়ের বিস্তৃত রেঞ্জ। আমরা অনেক ক্ষণ লেকের এর কাছে সময় কাটিয়ে, ছবি তুলে রওনা দিলাম ঘাটশিলা র উদ্দেশ্যে। জামশেদপুরে অনেক ঘুরে দেখার মত অনেক জায়গা আছে। কিন্তু এই যাত্রায় সেসব আর ঘোরা হবে না।পরে আবারও আসবো, সময় নিয়ে পুরোটা ঘুরব এই সংকল্প নিয়ে আমরা ঘাটশিলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
ঘাটশিলা পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেল। ঘাটশিলা তে আমরা প্রথমে গেলাম বুরুডি লেক। কী যে অসাধারণ এই লেকটি তা বলে বোঝানো যাবে না। একটা মাঝারি আকারের লেক, তার অন্যদিকে সারি সারি সবুজ পাহাড় এর রেঞ্জ । এত মোহময় পরিবেশ বলে বোঝানো যাবে না। চন্দ্রালোকিত রাতে এই লেকের পাড়ে বসে থাকতে কী অপূর্ব লাগতে পারে সেটাই ভাবছি। বুরুডি লেকে এখন জল অল্প। শুনেছি সেপ্টেম্বর থেকে লেকে বোটিংও করা যায়। লেকের পাশে ছোট ছোট কিছু দোকান, খাবার হোটেল আছে। দেখলাম একজন বয়স্ক মহিলা শুকনো কুল বিক্রি করছেন। আমি দু কিলো শুকনো কুল কিনে নিলাম, বাড়ি ফিরে কুলের আচার বানানোর জন্য।
বুরুডি লেকে আসার জন্য গ্রামের যে রাস্তা দিয়ে এলাম তার দুপাশে দেখলাম সারি সারি আম, জাম, কাঁঠাল এর গাছ । দেখে এত ভালো লাগলো। এগুলি পরিকল্পনা করে লাগানো হয়েছে। আম জাম ,কাঁঠাল ফললে গ্রামের বাচ্চা গুলো খেয়ে শেষ করতে পারবে না। আর রাস্তাটাও চমৎকার দেখতে লাগছে। এর মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালাতে খুব আনন্দ পেয়েছি।
ঘাটশিলা আমি আগে কখনও আসিনি। এই যাত্রায় এগুলো পরিকল্পনার মধ্যেই ছিল না , যাইহোক, আমরা এর পর যাবো, ঘাটশিলার কথা মনে হলেই যাঁর কথা মনে পড়ে সেই প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একসময়ের বাসভবন গৌরীকুঞ্জ দেখতে। এখানে বিভূতিভূষণ এর এই বাসগৃহটি একটি ছোট মিউজিয়ামের রূপ দেওয়া হয়েছে। সাহিত্যিকের ব্যবহৃত জিনিসপত্র রাখা আছে এখানে। তবে অবহেলা চোখে পড়ল। যতদুর মনে পড়ছে বিদ্যুৎ সংযোগও নেই। বাড়িটিও বহুকাল পরে সংস্কার করা হয়েছে। বিভূতিভূষণের নামাঙ্কিত বেশ কয়েটি স্মৃতি ভবনও চোখে পড়ল। সেগুলোও দেখলাম।
যাইহোক, সন্ধ্যা হয়ে আসছে, ভাবলাম, সুবর্ণরেখার বিখ্যাত রাতমোহনা দেখে আসা দরকার। সুবর্ণরেখায় এখন জল অনেক কম।ওই ভাঙ্গা ব্রিজটার ওপর অনেকক্ষণ বসে রইলাম। পাথুরে পাদদেশে সুবর্ণরেখার বয়ে যাওয়ার শব্দ অনেকক্ষণ বসে বসে শুনলাম। সন্ধ্যা নেমেছে। এবার যেতে হবে। হোটেল খুঁজতে হবে। অন্ধকারে গাড়িও চালাতে হবে। তবে গাড়ি চালানোটা বেশ এনজয় করছি আমি।
আমার বন্ধুটি হোটেল খুঁজতে লাগলো অনলাইন এ। পাওয়াও গেল। হোটেল বিভূতি বিহার । বেশ নাম আছে শুনেছি এই সরকারি হোটেলটির। হোটেলে গিয়ে গাড়ি পার্ক করে আমরা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হলাম। হোটেল টি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ভালো। ক্ষিধে পাচ্ছে, ডাইনিং হলে গিয়ে ডিনার এর অর্ডার দিলাম। ততক্ষণে গরম গরম চিকেন পকোড়া আর চা কফি খেলাম। এত ভালো চিকেন পকোড়া আমি আগে খুব কম ই খেয়েছি। আমি মাংস খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছি আজকাল, কিন্তু বিভূতি বিহার এর চিকেন পকোড়া আমার সত্যি মুখে লেগে আছে। যাইহোক, স্ন্যাকস খেয়ে আমরা একটু ঘোরাঘুরি করে রুমে এসে একটু রেস্ট নিয়ে একটু পরে ডিনার সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে আমরা গেলাম রঙ্কিনি দেবীর মন্দিরে। এখানে নাকি আগে নরবলি দেওয়া হত হলে শুনেছি। সেসব সত্যি মিথ্যে জানি না। মন্দির দর্শন সেরে আমরা এবার বেরিয়ে পড়ব ঝাড়গ্রাম এর উদ্দেশ্যে। সেখানে আমাদের এক খুব কাছের বন্ধু দেখা করতে আসবে আমাদের সাথে তার দুই পুচকে ছেলে মেয়ে সহ। কস্তুরী। সে আমার বন্ধুপত্নী, আমার বোন কাম বন্ধু। ওর বর রাজেশ আমার পুরোনো কলেজের কলিগ। রাজেশ - কস্তুরীর আমার বেশ কয়েকটি ভ্রমণের সঙ্গী হয়েছে। ওরা থাকে শালবনী।
আজ ই ঝাড়গ্রাম ঘুরে কলকাতা ফিরব শুনে কস্তুরী দেখা করতে আসছে ছেলে মেয়ে সহ ওদের গাড়িতে ঝাড়গ্রাম। ঝাড়গ্রামে কিছুক্ষণ আমরা একসাথে কাটিয়ে কলকাতা ফিরব এমন ই পরিকল্পনা।
আমরা ঝাড়গ্রামে কস্তুরীরা পৌঁছনোর আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম। ওর পৌঁছতে আরও কিছু দেরি। ঝাড়গ্রামে আসার পথ টা কি যে সুন্দর কী বলি! রাস্তার দুপাশে শালের জঙ্গল। এখন শাল গাছে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে। নুতন পাতা আসছে। আর তার রং একটা অদ্ভূত মায়া মাখানো সবুজ। আর আগের শুকনো পাতা ঝরে জঙ্গলময় বিছিয়ে আছে। কী অপূর্ব।
আমাদের হাতে একটু সময় আছে তাই কস্তুরী আসার আগেই বেশ কিছু জায়গা ঘুরে নেওয়া যেতে পারে। আমরা প্রথমে শালের জঙ্গলে ঘেরা পথ দিয়ে গেলাম ঝাড়গ্রামের বিখ্যাত প্রাচীন কনক দুর্গা মন্দির দেখতে। পুরোনো মন্দির সংস্কার করে নুতন মন্দির তৈরি হয়েছে। প্রচুর হনুমান দেখলাম মন্দির চত্বরে। ঘন জঙ্গলের মাঝে এমন মন্দির আর তার চারপাশের এমন সুন্দর পরিবেশ দেখতে বেশ ভালো লাগে। মন্দিরের কাছেই বয়ে চলেছে ছোট্ট নদী ডুলুং। এখন জল প্রায় নেই বললেই চলে। আমরা একটু পা ভিজোলাম ডুলং এর জলে। মন্দির দেখে এবার গেলাম অদূরে ঝাড়গ্রাম এর প্রাচীন চিল্কিগড় রাজবাড়ী দেখতে।
ঝাড়গ্রাম শহর থেকে ১৪ কিলমিটার দূরে চিল্কিগড়। এখানে আছে জামবনীর রাজাদের একসময়কার প্রাসাদ, দুর্গ, ডুলুং নদী, কালাচাঁদের নবরত্ন মন্দির আর শিবের এক রত্নমন্দির। ডুলুং নদীর পারে এক সময় জামবনী রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ডুলুং নদীর পশ্চিম তীরে রাজবাড়ী আর পূর্ব পারে কনক দুর্গা মন্দির।
আমরা এসব দেখতে দেখতেই কস্তুরীর ফোন এল । ওরা এসে গেছে, ঝাড়্গ্রাম থেকে কনক দুর্গা যাওয়ার পথ টি ভারী সুন্দর। দুদিকে ঘন জঙ্গল। সেখানে আমাদের দেখা হল। কস্তূরীর সাথে এসেছে ওর দুই ছেলে-মেয়ে, অগ্নিশ আর আর্যা । আমরা কিছুক্ষণ জঙ্গলের মাঝে দাঁড়িয়ে গল্প করে দুটো গাড়ী নিয়ে গেলাম ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ী। রাজবাড়ী র প্রবেশ তোরণটি ভারী সুন্দর। ঢুকেই লাল মোরাম রাস্তা , দুপাশে ফুল বাগিচা। রাজবাড়ীর আউট হাউসে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগম বানিয়েছে ঝাড়্গ্রাম প্যালেস টুরিস্ট লজ। বুকিং না থাকলে রাজবাড়ী প্রবেশ করা যাবে না। আমরা বসলাম রাজবাড়ী বাইরে রেস্ট্রন্টে। কস্তুরী আমাদের জন্য অনেক উপহার সামগ্রী নিয়ে এসেছে। আর সাথে এনেছে দুজনের জন্য দু পাত্র ভর্তি খেজুড় গুড়। শীতে কিনে রেখেছিল আমাদেরকে দেওয়ার জন্য। ভালই হল। আমি শুকনো কুল কিনেছিলাম ঘাটশিলা থেকে। ভালই আচার বানানো যাবে। উপহার বিনিময় হল। অনেক গল্প হল। একসাথে খাওয়া হল। এসব করতে করতে রাত হয়ে গেল। কলকাতায় ফিরতে রাত হবে ভেবে সে রাত মেদিনিপুরে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। কস্তুরী ফিরে যাবে ওর শশুরবাড়ী আনন্দপুরে। আমরা সকালে কলকাতায় ফিরব। এর পর কস্তুরী আমাদেরকে নিয়ে গেল একটা নদীর ধারে। সেখানে বসে আমরা গল্প করলাম, চা খেলাম। আড্ডা দিলাম। এবার আলাদা হওয়ার পালা। কস্তূরীরা আমাদেরকে থাকার ভাল হোটেল ঠিক করে দিল। রাতের খাবার অর্ডার করে দিয়ে নিজেদের খাবার প্যাক করে বিদায় জানিয়ে চলে গেল।
মেদিনীপুর শহরের ঘিঞ্জি রাস্তাঘাট, খোলা ড্রেন, আর কিছু লোকের খ্রিষ্টপূর্ব যুগের মানসিকতা দেখে বিরক্ত লাগল। যাইহোক সেসব কথা আর লিখলাম না।
পরদিন হোটেলের কমপ্লিমেন্টারী ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।।